গাজীপুরে আগুনে পুড়ে একজনের মৃত্যু, শঙ্কায় ৩০: আশার ভেতর শঙ্কা

গাজীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩২ জনের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এখনও কাতরাচ্ছেন ৩০ জন।

মর্মান্তিকভাবে দগ্ধ আর স্বজনদের মধ্যে হা-হুতাশ চলছেই। ‘কেউই শঙ্কামুক্ত নন’-এ শব্দই শুধু তাড়া করছে প্রতীক্ষায় থাকা স্বজনদের। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না।

চিকিৎসকরা বলছেন, দগ্ধ রোগীরা ১০ শতাংশের উপরে পুড়লেই- শঙ্কামুক্ত বলা যায় না। সেই সঙ্গে চিকিৎসকরা আরও বলছেন, ‘সৃষ্টিকর্তা সবই পারেন, সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারেন।’

এমন আশা আর নিরাশার মধ্যে দগ্ধদের স্বজনরা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দিন-রাত কাটাচ্ছেন। এদের অধিকাংশই সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। তারা খেয়ে না খেয়ে সুসংবাদের অপেক্ষা করছেন।

আগুনে পুড়ে ৩০ জন ভর্তি রয়েছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। তাদের মধ্যে ৮ জন আইসিইউতে আর লাইফ সাপোর্টে আছেন দুজন। চিকিৎসক বলছেন, ‘আইসিইউতে সিট খালি হলে দগ্ধ আরও কয়েকজনকে রাখা হবে। পর্যায়ক্রমে তাদের লাইফ সাপোর্ট লাগবেই। আমরা সর্বোচ্চ সেবা দিচ্ছি, রাত-দিন হাসপাতালেই থাকছি। কিন্তু, অধিকাংশ রোগীর শরীর ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পুড়ে গেছে।’

লাইফ সাপোর্টে থাকা ৯৫ শতাংশ দগ্ধ সোলাইমান মোল্লার মৃত্যু হয় শুক্রবার সকালে। ১০০ শতাংশ দগ্ধ রাব্বিসহ মহিদুল আছেন লাইফ সাপোর্টে। আইসিইউতে ভর্তি ৮ জনের সবাই ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ দগ্ধ।

বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পার্থ শংকর পাল যুগান্তরকে জানান, শুক্রবার একজনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে ভর্তি ৩০ জনের মধ্যে ৮ জন আইসিইউতে রয়েছে। তারা চরম সংকটাপন্ন। প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা অতিরিক্ত চিকিৎসক-নার্স-স্টাফ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যথাযথ সেবা দিতে। কিন্তু, বিধ্বংসী আগুন তাদের এমন ভাবে গ্রাস করেছে যা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েও আমরা তাদের প্রাণে বাঁচাতে পারছি না। সময় যত যাচ্ছে-লাইফ সাপোর্টে দেওয়ার সংখ্যা তত বাড়বে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি-সৃষ্টিকর্তা সবই পারেন। সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে তিনিই মানুষকে বাঁচাতে পারেন।

অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাস বলেন, গাজীপুরে দগ্ধদের মধ্যে এটিই প্রথম মৃত্যু। সাম্প্রতিক বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ অনেককে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের শরীর দগ্ধ হলেও শ্বাসনালির ক্ষতি হয়নি-পোড়েনি। তাই সবাই সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু, গাজীপুরে দগ্ধদের বিষয়টি একেবারেই আলাদা। তাদের শরীর যেমন ভয়াবহ ভাবে পুড়েছে-তেমনি শ্বাসনালিও পুড়েছে। ফলে দগ্ধ সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক। আমরা একটি চিকিৎসক গ্রুপ খুলে সর্বদাই কাজ করছি। দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছি না।

এক সিনিয়র নার্স জানান, দগ্ধরা অধিকাংশ সুবিধাবঞ্চিত। সরকার চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিয়েছে। বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, একেকজন দগ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে ৪-৫ জন স্বজন হাসপাতালের বারান্দায় অপেক্ষা করছেন। তাদের খাবার ব্যবস্থাও জরুরি। স্বজনদের চোখ-মুখই বলে দিচ্ছে তারা কতটা অসহায়, ক্ষুধার্ত। বর্তমানে যারা ভর্তি রয়েছেন, তাদের কেউ ৮০ শতাংশ, কেউ ৯০ শতাংশ, কেউ আবার ১০০ শতাংশ পর্যন্ত দগ্ধ। ৫০ শতাংশের বেশি হলে স্বাভাবিকভাবে তাদের কামব্যাক করার সুযোগ কম।

প্রতিদিনই হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ রোগী আসছেন। সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার পরও অনেকে না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছেন। তবু মানুষ সচেতন হচ্ছেন না। যেসব কারণে যাদের গাফিলতির জন্য এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। দিন দিন এমন দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে – বলছিলেন বার্ন ইউনিটের জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক।

আইসিইউতে ৩০টি বেড রয়েছে। যে হারে দগ্ধ রোগী আসে, আইসিইউর প্রয়োজন ন্যূনতম ১৫০টি। এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আজিজুল হক নামে ২৪ বছর বয়সি একজনকে বৃহস্পতিবার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

নার্গিস আক্তার এবং তার স্বামী মহিদুল-দুজনই আইসিইউতে। দুজনেরই শরীর পুড়ে গেছে প্রায় ১০০ শতাংশ। শুক্রবার আইসিইউর অদূরে বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন বাবা আব্দুর রাজ্জাক। সকালে তার সামনে দিয়েই লাশ হয়ে বের হয়েছে দগ্ধ সোলয়মানের।

অসহায় রাজ্জাক বলছিলেন, ‘কি করব-কি করলে আমার মাইয়া, মাইয়ার জামাই বাঁচব। আমরা দিনমজুর মানুষ, কেমনে বাঁচুম। এরার (মেয়ে-মেয়ের জামাই) সন্তানরা কেমনে বাঁচবে।’

একই পরিবারের শিল্পী আক্তার এবং তার দুই শিশু সন্তানের অবস্থাও সংকটাপন্ন। বাবা সজল মিয়া জানান, তার স্ত্রীসহ ২ বছরের কন্যা তায়বা আক্তার এবং ৫ বছরের ছেলে তৌহিদ আগুনে পুড়েছে। তারাই তার একমাত্র সম্বল। তাদের কিছু হয়ে গেলে, তিনি কি নিয়ে বাঁচবেন। সময় যত যাচ্ছে সেই সঙ্গে ঘনাচ্ছে ভয়, তাদের কিছু হয়ে গেলে তিনি যাবেন কোথায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *