আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূলকে গুরুত্ব দিয়ে মাঠ গোছাচ্ছে ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এজন্য গত বছরের ১৩ জুলাই সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ঘোষিত ‘রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা’ নিয়ে জেলায় জেলায় যাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা।
এসব সমাবেশে নেতা-কর্মীসহ দেশবাসীর উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা ইতোমধ্যে জনগণের কাছে তুলে ধরেছি। আমরা ৩১ দফাকে কর্মসূচি আকারে আবার মানুষের সামনে নিয়ে যাচ্ছি। জানা যায়, সরকার পতনের পর থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূলের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। বিভিন্ন জেলায় সমাবেশের আয়োজন করে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখছেন। সাংগঠনিকভাবে বিভাগ ও জেলার দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন দফায় দফায়। তাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
নির্বাচন ঘিরে হাইকমান্ডের এমন তৎপরতা চোখে পড়েছে। তৃণমূল নেতারা বলছেন, তারেক রহমান সবসময় তৃণমূলকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। আন্দোলন থেকে শুরু করে যেকোনো কর্মসূচি পালনে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে সংগঠনকে ঢেলে সাজাচ্ছেন। আন্দোলন কর্মসূচিতে সক্রিয়দের নেতৃত্বের সামনে আনা হচ্ছে। তারা বলেন, তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে উৎপাদন উন্নয়নের রাজনীতির প্রতিশ্রুতি বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। তার বক্তব্যে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছেন। জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশনায়ক তারেক রহমান তৃণমূলসহ সারা দেশে বিএনপিকে সংগঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।
স্বৈরাচার হাসিনাকে হটানোর জন্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই আন্দোলনের শত শত নেতা-কর্মীর রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের পতন হলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের শতভাগ সমর্থন রয়েছে। আগামী নির্বাচনের জন্য তারেক রহমান জেলায় জেলায়, বিভাগীয় পর্যায়ে সভাবেশ করে নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করছেন। আগামী দিনে একটি নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমেই দেশের সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে বলে আমরা আশাবাদী। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাদের উদ্দেশে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, বিগত সময়ে বিএনপির দুঃসময়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীরাই দলের পক্ষে থেকে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেছেন। এক-এগারোর সময় ষড়যন্ত্র হয়েছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্র ছিল বিএনপির বিরুদ্ধে, তখন তারা বিএনপিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে সে সময় সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছেন।
তৃণমূল নেতা-কর্মীরা হলেন বিএনপির প্রাণ। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আচার-আচরণেও গুণগত পরিবর্তন জরুরি। তাই আমার আহ্বান কোনো প্রলোভন কিংবা উসকানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সমাজের নেতৃত্ব দানের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখুন। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠায় এই সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেট হওয়া জরুরি।
আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা ইতোমধ্যে জনগণের কাছে তুলে ধরেছি। আমরা ৩১ দফাকে কর্মসূচি আকারে আবার মানুষের সামনে নিয়ে যাচ্ছি
জানতে চাইলে খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো দেশবাসীর মাছে দারুণ সাড়া ফেলেছে। আগামীর বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য তার অপেক্ষায় দেশবাসী। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য তারেক রহমান দলের নেতা-কর্মীসহ দেশবাসীকে এক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, তারেক রহমানের দল পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। আমরা আশাবাদী আগামী দিনে সৎ ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের তিনি মূল্যায়ন করবেন।
৩১ দফা নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে বিএনপি : সংবিধানের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের ৩১ দফা নিয়ে আবারও মানুষের কাছে যাচ্ছে বিএনপি। নতুন পরিবর্তিত রাজনীতিতে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তৈরি হওয়ায় সংস্কার-প্রশ্নে নিজেদের অবস্থানও তুলে ধরা হচ্ছে। গত বছরের ১৩ জুলাই সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ ৩১ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এই রূপরেখার উল্লেখযোগ্য দিক হলো- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছানো; ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন; সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; পর পর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না; সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিবেচনা করা।
এ ছাড়া রয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল; ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন; ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন; ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন; সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ; দেড় দশকে গুম-খুনের বিচার; ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত না করা; মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন; যুক্তরাজ্যের আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন; সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালুর প্রতিশ্রুতি। আরও রয়েছে, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন, আস্থাভোট ও অর্থবিলের বিষয় ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশনের আইন প্রণয়ন।