রাসুলুল্লাহ (রা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামের শিক্ষা ও নবীজি (সা.)-এর আদর্শ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীরাই অগ্রগামী। যদিও নবীজি (সা.)-এর স্ত্রীরা ‘আহলুল বাইতের’ অংশ ছিলেন না, তবু কোনো সন্দেহ নেই তাঁরা নবী পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। নবীজি (সা.)-এর স্ত্রী হিসেবে তাঁরা ছিলেন অনন্য মর্যাদা অধিকারী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবীপত্নীরা! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও।
’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩২)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর স্ত্রীরা তাদের মায়ের মতো।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৬)
উম্মাহাতুল মুমিনিনদের ভেতর দ্বিন ও দ্বিনি ইলমের প্রসারে সাইয়েদা আয়েশা (রা.) ছিলেন সবচেয়ে অগ্রগামী। জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞায় তিনি রাসুল (সা.)-এর অন্য স্ত্রীদের তুলনায় বহুগুণ এগিয়ে ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে তিনি দুই হাজার ২১০টি হাদিস বর্ণনা করেন।
আবু হুরায়রা (রা.)-এর পর তিনিই সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। যথাক্রমে নবীজি (সা.)-এর অন্য স্ত্রীদের বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা হলো—উম্মে সালামা (রা.) ৩৭৮টি, মায়মুনা বিনতে হারিস (রা.) ৭৬টি, উম্মে হাবিবা (রা.) ৬৫টি, হাফসা (রা.) ৬০টি, জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.) ১১টি, সাফিয়্যাহ (রা.) ১০টি, জুওয়াইরিয়া (রা.) সাতটি, সাওদা (রা.) পাঁচটি। (প্রবন্ধ : আদাদু রিওয়াতি উম্মাহাতিল মুমিনিন, ইসলাম ওয়েব ডটনেট)
শুধু ইন্তেকালের পর নয়, বরং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ও উম্মাহাতুল মুমিনিনরা নানা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যেমন হুদাইবিয়ার সন্ধিপত্র লেখা শেষ হলে আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবিদের বলেন, তোমরা ওঠো, কোরবানি করো এবং মাথা কামিয়ে ফেলো।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনবার তা বলার পরও কেউ উঠল না। তাদের কাউকে উঠতে না দেখে নবীজি (সা.) উম্মু সালামা (রা.)-এর কাছে এসে লোকদের এই আচরণের কথা বলেন। উম্মু সালামা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর নবী, আপনি যদি তাই চান, তাহলে আপনি বাইরে যান ও তাদের সঙ্গে কোনো কথা না বলে আপনার উট আপনি কোরবানি করুন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুণ্ডিয়ে নিন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী আল্লাহর রাসুল (সা.) বেরিয়ে গেলেন এবং কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে নিজের পশু কোরবানি দিলেন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুণ্ডালেন। তা দেখে সাহাবিরা উঠে দাঁড়াল এবং নিজ নিজ পশু কোরবানি দিল।
তারা পরস্পরের মাথা কামিয়ে দিল। অবস্থা এমন হলো যে ভিড়ের কারণে একে অপরের ওপর পড়তে লাগল। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৭৩১)
ইসলামের সেবায় উম্মাহাতুল মুমিনিনদের অবদানের বিস্তারিত বর্ণনা সংক্ষিপ্ত এই লেখায় দেওয়া সম্ভব নয়। কেননা তাঁরা ইসলামের সেবায় বহুমুখী অবদান রাখেন এবং তার পরিধিও ছিল সুবিশাল। সার্বিক বিচারে তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন দ্বিনের একেকটি প্রতিষ্ঠানের মতো। ড. আলী আবদুল বাসেত মজিদ যথার্থই লিখেছেন, ‘দ্বিনের প্রচার ও সুন্নতে নববীর প্রসারে উম্মাহাতুল মুমিনিনদের বিশেষ অবদান ছিল, বিশেষত নারীদের ভেতর। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন একেকটি বিদ্যালয়ের মতো। যেখানে থেকে অন্বেষীরা জ্ঞান অর্জন করত, প্রশ্নকারী উত্তর পেত, ফতোয়াপ্রত্যাশীরা ফতোয়া পেত এবং সংশয়কারীদের সন্দেহ দূর হতো।…আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একাধিক বিয়ের মাধ্যমে এই বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তিনি ৯ জন, মতান্তরে ১১ জন স্ত্রী রেখে গেছেন। তাঁদের প্রত্যেকে নবীজি (সা.) থেকে (কোরআন-সুন্নাহ) শ্রবণ করেছেন এবং তাঁর প্রাত্যহিক জীবন ও ইবাদত-বন্দেগি প্রত্যক্ষ করেছেন।’ (মানাহিজুল মুহাদ্দিসিন, পৃষ্ঠা-১৭৪)
তাঁরা চির অনুসরণীয়
নবীজি (সা.)-এর নৈকট্য, সান্নিধ্য ও স্নেহ-মমতায় ধন্য হওয়ায় নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে নবী পরিবারের সদস্যরা মুসলিম জাতির জন্য চির অনুসরণীয়। মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘হে লোক সব! নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আমি এমন জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা তা অনুসরণ করলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না : আল্লাহর কিতাব (কোরআন) ও আমার পরিবার তথা আহলে বাইত।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৭৮৬)
আল্লাহ মুহাম্মদ (সা.), তাঁর পরিবার, সাহাবি ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর সব অনুসারীর প্রতি শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। আমিন।